//কক্সবাজারের মেগা প্রকল্পে ৩০০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ
//ভূমি অধিগ্রহণ, রোহিঙ্গা ডাটাবেজ সহ একাধিক খাতে অনিয়মের অনুসন্ধান
//ক্ষমতার অপব্যবহার করে চাকরিচ্যুত হন অভিযোগকারী দুদক কর্মকর্তা
বিতর্কিত রাতের ভোটের নির্বাচন কমিশন সচিব এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে অবশেষে দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কক্সবাজারে প্রায় তিন লক্ষ কোটি টাকার বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে তার সরাসরি যোগসাজশে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ বছরে কক্সবাজারে বাস্তবায়িত ৭৫টি বৃহৎ প্রকল্পের মধ্যে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, ভূমি অধিগ্রহণ, রোহিঙ্গাদের ডাটাবেজ তৈরি এবং রেললাইন প্রকল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে এই দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।
দুদকের কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার এই তদন্তের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, গত ১৭ মার্চ দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি কক্সবাজার কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। কমিশনের উপ-পরিচালক (অনুসন্ধান ও তদন্ত) ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীনের বিরুদ্ধে কক্সবাজারের মেগা প্রকল্পগুলোতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গুলশান আনোয়ার আরও জানান, দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই তারা অনুসন্ধান কাজ শুরু করেছেন এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করতে আশাবাদী।
দুদক সূত্র আরও জানায়, হেলালুদ্দীনের বিরুদ্ধে তিনটি প্রকল্প থেকে প্রায় ৮০ কোটি টাকা লোপাট, রোহিঙ্গাদের এনআইডি ও পাসপোর্ট প্রদানে জালিয়াতি এবং ৫৫ হাজার ৩১০ জনকে অবৈধভাবে ভোটার করার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। বিগত সরকারের আস্থাভাজন এবং ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের অন্যতম কারিগর হিসেবে পরিচিত এই সাবেক সচিবের বাড়ি কক্সবাজারে। অবসরের পর তিনি সরকারি দলের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হওয়ারও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি কক্সবাজারের তৎকালীন জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও মেয়রের যোগসাজশে দুর্নীতির একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন।
উল্লেখ্য, সাবেক দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন ২০২১ সালেই তার ৬২০ পৃষ্ঠার এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এই ব্যাপক দুর্নীতির চিত্র বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছিলেন। তবে তৎকালীন সরকার হেলালের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, বরং প্রভাবশালী এই সচিব ও তার চক্রের সদস্যরা প্রভাব খাটিয়ে শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করে। সরকারের পটপরিবর্তনের পর বর্তমানে হত্যা ও বিস্ফোরক মামলার আসামি হিসেবে জেলহাজতে থাকা হেলালুদ্দীন এবার দুর্নীতির জালে আটকা পড়লেন।
তদন্তে আরও জানা যায়, ২০২০ সালে কক্সবাজার পৌরসভার পানি শোধনাগার প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তৎকালীন স্থানীয় সরকার সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ তার সিন্ডিকেটের সদস্য কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমানকে প্রায় আট কোটি টাকার চেক প্রদান করেন এবং ওই অর্থের একটি অংশ ঘুষ হিসেবে তার স্ত্রীর নামে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। দুদকের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তার নির্দেশে ওই অর্থ ছাড় দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, হেলালের প্রভাব খাটিয়ে একটি দালাল চক্র ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে অর্থ উত্তোলন করত। এছাড়া, তার ভাইয়েরা রোহিঙ্গাদের এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগও উঠেছে।
দুদক জানিয়েছে, ক্ষমতার দাপটে এতদিন কক্সবাজারের এই ৮০ কোটি টাকার দুর্নীতির তদন্ত ধামাচাপা পড়েছিল। এখনও এই সিন্ডিকেটের মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। চাকরিচ্যুত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন তার তদন্ত প্রতিবেদনে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ সাতজন রাজনীতিবিদ, দুইজন চেয়ারম্যান, ২০ জন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা, চারজন পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তা, ২৩ জন সার্ভেয়ার, সাতজন কানুনগো, ছয়জন তহশীলদার, দুইজন সাব-রেজিস্ট্রার, ছয়জন অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা ও তিনজন ব্যাংক ম্যানেজারের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করেছিলেন। এখন দেখার বিষয়, দুদকের এই নতুন উদ্যোগ কতদূর পর্যন্ত গড়ায় এবং এই রাঘব বোয়ালরা আইনের আওতায় আসে কিনা।
কপিরাইট: এরফান হোছাইন, পূর্বকোণের কক্সবাজার প্রতিনিধি:
0 মন্তব্যসমূহ